Skip to main content

বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা

১৯২৬ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটি ভাষন দেন যার নাম “বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা” । এটি বাঙলা প্রাদেশিক সম্মেলনে প্রদান করেন। পরে তা হিন্দু সংঘ পত্রিকায় ছাপা হয় ১৯ শে আশ্বিন ১৯৩৩ সালে। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক  এর ভাষায় ১৯৩০ সালের দিকে প্রকাশিত শরৎচন্দ্রের বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা পর এত (আহামদ ছফার বাঙালি মুসলমানের মন) প্রভোক্যাটিভ রচনা বাংলা ভাষায় পড়ি নাই।

কোন একটা কথা বহু লোকে মিলিয়া বহু আস্ফালন করিয়া বলিতে থাকিলেই কেবল বলার জোরেই তাহা সত্য হইয়া উঠে না । অথচ এই সম্মিলিত প্রবল কন্ঠস্বরের একটা শক্তি আছে । এবং মোহও কম নাই । চারিদিক গমগম করিতে থাকে – এবং এই বাস্পাচ্ছন্ন আকাশের নীচে দুই কানের মধ্যে নিরন্তর যাহা প্রবেশ করে , মানুষ অভিভূতের মতো তাহাকেই সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিয়া বসে । propaganda বস্তুত এই-ই । বিগত মহাযুদ্ধের দিনে পরস্পরের গলা কাটিয়া বেড়ানই যে মানুষের একমাত্র ধর্ম ও কর্তব্য , এই অসত্যকে সত্য বলিয়া যে দুই পক্ষের লোকেই মানিয়া লইয়াছিল , সে ত কেবল অনেক কলম এবং অনেক গলার সমবেত চীৎকারের ফলেই । যে দুই- একজন প্রতিবাদ করিতে গিয়াছিল , আসল কথা বলিবার চেষ্টা করিয়াছিল , তাহাদের লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের অবধি ছিল না ।

কিন্তু আজ আর সেদিন নাই । আজ অপরিসীম বেদনা ও দুঃখ ভোগের ভিতর দিয়া মানুষের চৈতন্য হইয়াছে যে , সত্য বস্তু সেদিন অনেকের অনেক বলার মধ্যেই ছিল না । বছর – কয়েক পূর্বে , মহাত্মার অহিংস অসহযোগের যুগে এমনি একটা কথা এদেশে বহু নেতায় মিলিয়া তারস্বরে ঘোষনা করিয়াছিলেন যে , হিন্দু – মুসলিম মিলন চাই-ই । চাই শুধু কেবল জিনিসটা ভাল বলিয়া নয় , চাই-চ এইজন্যে যে , এ না হইলে স্বরাজ বল , স্বাধীনতা বল , তাহার কল্পনা করাও পাগলামি । কেন পাগলামি এ কথা যদি কেজ তখন জিজ্ঞাসা করিত , নেতৃবৃন্দেরা কি জবাব দিতেন তাঁহারাই জানেন , কিন্তু লেখায় , বক্তৃতায় ও চীৎকারের বিস্তারে কথাটা এমনি বিপুলায়তন ও স্বতঃসিদ্ধ সত্য হইয়া গেল যে, এক পাগল ছাড়া আর এত বড় পাগলামি করিবার দুঃসাহস কাহারও রহিল না ।

তার পরে এই মিলন-ছায়াবাজীর রোশনাই যোগাইতেই হিন্দুর প্রাণান্ত হইল । সময় এবং শক্তি কত যে বিফলে গেল তাহার ত হিসাবও নাই । ইহারই ফলে মহাত্মাজী খিলাফ-আন্দোলন , ইহারই ফলে দেশবন্ধুর প্যাক্ট। অথচ এতবড় দুটো ভুয়া জিনিসও ভারতের রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কম আছে । প্যাক্টের তবু বা কতক অর্থ বুঝা যায় ; কারণ , কল্যাণের হউক , অকল্যানের হউক , সময়-মত একটা ছাড়রফা করিয়া কাউন্সিল – ঘরে বাঙলা সরকারকে পরাজিত করিবার একটা উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু খিলাফৎ-আন্দোলন হিন্দুর পক্ষে শুধু অর্থহীন নয়, অসত্য । কোনো মিথ্যাকে অবলম্বন করিয়া জয়ী হওয়া যায় না । এবং যে মিথ্যার জগদ্দল পাথর গলায় বাধিয়া এত বড় অসহযোগ - আন্দোলন শেষ পর্যন্ত রসাতলে গেল, সে এই খিলাফৎ । 

স্বরাজ চাই , বিদেশীর শাসন - পাশ হইতে মুক্তি চাই, ভারতবাসীর এই দাবির বিরুদ্ধে ইংরাজ হয়তো একটা যুক্তি খাড়া করিতে পারে , কিন্তু বিশ্বের দরবারে তাহা টিকে না । পাই বা না পাই , এই জন্মগত অধিকারের জন্য লড়াই করায় পুণ্য আছে , প্রাণপাত হইলে অন্তে স্বর্গবাস হয় । এই সত্যকে অস্বীকার করিতে পারে জগতে এমন কেহ নাই । কিন্তু খিলাফৎ চাই – এ কোন কথা ? যে দেশের সহিত ভারতের সংস্রব নাই , যে-দেশের মানুষে কি খায় , কি পরে , কি রকম তাদের চেহারা, কিছুই জানি না , সেই দেশ পূর্বে তুর্কীর শাসনাধীন ছিল, এখন যদিচ , তুর্কী লড়ইয়ে হারিয়াছে তথাপি সুলতানকে তাহা ফিরাইয়া দেওয়া হউক , কারন পরাধীন ভারতীয় মুসলমান-সমাজ আবদার ধরিয়াছে । এ কোন স্বগত প্রার্থনা ? আসলে ইহাও একটা প্যাক্ট । ঘুষের ব্যাপার । যেহেতু আমরা স্বরাজ চাই , এবং তোমরা চাও খিলাফৎ - অতএব এস, একত্র হইয়া আমরা খিলাফতের জন্য মাথা খুটি এবং তোমরা স্বরাজের জন্য তাল ঠুকিয়া অভিনয় শুরু কর । কিন্তু এদিকে বৃটিশ গভর্নমেন্ট কর্ণপাত করিল না , এবং অদিকে যাহার জন্য খিলাফৎ সেই খলিফাকেই তুর্কীরা দেশ হইতে বাহির করিয়া দিল । সুতরাং এইরুপ খিলাফৎ- আন্দোলন যখন নিতান্তই অসার ও অর্থহীন হইয়া পড়িল , তখন নিজের শূন্য-গর্ভতায় সে শুধু নিজেই মরিল না ভারতের স্বরাজ - আন্দোলনেরও প্রানবধ করিয়া গেল। বস্তুতঃ এমন ঘুষ দিয়া , প্রলোভন দেখাইয়া পিঠ চাপড়াইয়া কি স্বদেশের মুক্তি-সংগ্রামে লোক ভরতি করা যায় , না করিলেই বিহয় লাভ হয়? হয় না , এবং কোনদিন হইবে বলিয়াও মনে করি না। 

এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি খাটিয়াছিলেন মহাত্মাজী নিজে। এতখানি আশা বোধ করি কেউ করে নাই, এতবড় প্রতারিতও বোধা করি কেউ হয় নাই । সেকালে বড় বড় মুসলিম পান্ডাদের কেহ-বা হইয়াছিলেন তাহার দক্ষিন হস্ত, কেহ-বা বাম হস্ত। কেহ-বা চক্ষু কর্ণ, কেহ-বা আর কিছু- হায়রে ! এতবড় তামাশার ব্যাপার কি আর কোথাও অনুষ্ঠিত হইয়াছে । পরিশেষে হিন্দু-মুসলমান সাধু মানুষ তিনি, বোধ হয় প্রানটা তাহার টিকিয়া গেল। ভ্রাতার অধিক, সর্বক্ষেত্রে প্রিয় মিঃ মহম্মদ আলিই বিচলিত হইলেন সবচেয়ে বেশী। তাহার চোখের উপরেই সমস্ত ঘটিয়াছিল, অস্ত্রুপাত করিয়া কহিলেন , আহা ! বড় ভাল লোক এই মহাত্মাজীটি । ইহার সত্যকার উপকার কিছু করাই চাই । অতএব আগে যাই মক্কায়, গিয়া পীরের সিন্নি দিই, পরে ফিরিয়া আসি কলমা পড়াইয়া কাফের-ধর্ম ত্যাগ করাইয়া তবে ছাড়িব। 

শুনিয়া মহাত্মা কহিলেন, পৃথিবী দ্বিধা হও।
বস্তুতঃ মুসলমান লুন্ঠনের জন্যই ভারতে প্রবেশ করিয়াছিল, বাজ্য প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য আসে নাই। সেদিন কেবল লুঠ করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই । মন্দির ধ্বংস করিয়াছে, প্রতিমা চূর্ণ করিয়াছে , নারীর সতীত্ব হানি করিয়াছে , বস্ততঃ অপরের ধর্ম ও মনুষ্যত্বের উপরে যতখানি আঘাত ও অপমান করা যায়, কোথাও কোন সঙ্কোচ মানে নাই । 

দেশের রাজা হইয়াও এই জঘন্য প্রবৃত্তির হাত হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারে নাই । ঔরংজেব প্রভৃতি নামজাদা সম্রাটের কথা ছাড়িয়া দিয়াও যে আকবর বাদশাহের উদার মজ্জাগত হইয়া উঠিয়াছে । পাবনার বীভৎস ব্যাপারে অনেককেই বলিতে শুনি, পশ্চিম হইতে মুসলমান মোল্লারা আসিয়া নিরীহ ও অশিক্ষিত মুসলমান প্রজাদের উত্তেজির করিয়া এই দুষ্কার্য করিয়াছে । কিন্তু এমনিই যদি পশ্চিম হইতে হিন্দু পুরোহিতের দল আসিয়া , কোন হিন্দুপ্রধান স্থানে এমনি নিরীহ ও নিরক্ষর চাষাভুষাদের এই বলিয়া উত্তেজিত করিবার চেষ্টা করেন যে নিরপরাধ মুসলমান প্রতিবেশীদের ঘরদোরে আগুন ধরাইয়া সম্পত্তি লুঠ করিয়া মেয়েদের অপমান অমর্যাদা করিতে হইবে , তাহা হইলে সে সব নিরক্ষর হিন্দু কৃষকের দল উহাদের পাগল বলিয়া গ্রাম হইতে দূর করিয়া দিতে একমুহূর্ত ইতস্ততঃ করিবে না। 

কিন্তু কেন এইরূপ হয়? ইহা কি কেবল শুধু অশিক্ষারই ফল? শিক্ষা মানে যদি লেখাপড়া জানা হয় , তাহা হইলে চাষী-মজুরের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানে বেশি তারতম্য নাই। কিন্তু শিক্ষার তাৎপর্য যদি অন্তরের প্রসার ও হৃদয়ের কালচার হয় তাহা হইলে বলিতেই হইবে উভয় সম্প্রদায়ের তুলনাই হয় না। হিন্দুনারীহরণ ব্যাপারে সংবাদপত্রওয়ালারা প্রায়ই দেখি প্রশ্ন করেন , মুসলমান নেতারা নীরব কেন? তাহাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা যে পুনঃ পুনঃ এতবড় অপরাধ করিতেছে , তথাপি প্রতিবাদ করিতেছেন না কিসের জন্য? মুখ বুজিয়া নিঃশব্দে থাকার অর্থ কি? কিন্তু আমার তো মনে হয় অর্থ অতিশয় প্রাঞ্জল। তাহারা শুধু অতি বিনয়বশতঃ মুখ ফুটিয়া বলিতে পারেন না, বাপু, আপত্তি করব কি , সময় এবং সুযোগ পেলে ও-কাজে আমরাও লেগে যেতে পারি ।

মিলন হয় সমানে সমানে। শিক্ষা সমান করিয়া লইবার আশা আর যেই করুক আমি ত করি না । হাজার বৎসরে কুলায় নাই , আর হাজার বৎসরে কুলাইবে না। এবং ইহাকেই খিলাফৎ করিয়া, প্যাক্ট করিয়া, ডান-বাঁ – দুই হাতে মুসলমানের পুচ্ছ চুলকাইয়া স্বরাজ যুদ্ধে নামাইতে পারিবে , এ দুরাশা দুই-একজনার হয়ত ছিল, কিন্তু মনে মনে অধিকাংশেরই ছিল না। তাঁহারা ইহাই ভাবিতেন দুঃখ-দুর্দশার মত শিক্ষক ত আর নাই , বিদেশী বুরোক্রেসীর কাছে নিরন্তর নাঞ্ছনা ভোগ করিয়া হয়ত তাহাদের চৈতন্য হইবে , হয়ত হিন্দুর সহিত কাঁধ মিলাইয়া স্বরাজরথে ঠেলা দিতে সম্মত হইবে । ভাবা অন্যায় নয়, শুধু ইহাই তাঁহারা ভাবিলেন না যে , লাঞ্ছনাবোধও শিক্ষাসাপেক্ষ। যে লাঞ্ছনার আগুনে স্বর্গীয় দেশবন্ধুর হৃদয় দগ্ধ হইয়া যাইত। আমার গায়ে তাহাতে আচটুকুও লাগে না। এবং তাহার চেয়েও বড় কথা এই যে, দুর্বলের প্রতি অত্যাচার করিতে যাহাদের বাধে না।, সবলের পদলেহন করিতেও তাহাদের ঠিক ততখানিই বাধে না। সুতরাং এ আকাশকুশুমের লোভে আত্মবঞ্চনা করি আমরা কিসের জন্য? হিন্দু –মুসলমান – মিলন একটা গালভরা শব্দ , অতিরিক্ত সে আর কোন কাজেই আসে নাই । এ মোহ আমাদিগকে ত্যাগ করিতেই হইবে । তোমরা হিন্দু ছিলে; সুতরাং রক্ত –সম্বন্ধে তোমরা আমাদের জ্ঞাতি। জ্ঞাতিবধে মহাপাপ, অতএব কিঞ্চিৎ করুণা কর। এমন করিয়া দয়াভিক্ষা মিলন-প্রয়াসের মত অগৌরবের বস্তু আমি ত আর দেখিতে পাই না। স্বদেশে বিদেশে ক্রীশ্চান বন্ধু আমার অনেক আছেন। কাহারও বা পিতামহ , কেহ-বা স্বয়ং ধর্মান্তর গ্রহন করিয়াছেন, কিন্তু নিজে হইতে তাঁহারা আজও আমাদের ভাইবোন নয়। একজন মহিলাকে জানি ,অল্প বয়সেই তিনি ইহলোক হইতে বিদায় গ্রহন করিয়াছে, এতবড় শ্রদ্ধার পাত্রীও জীবনে আমি কম দেখিয়াছি ! আর মুসলমান? আমাদের একজন পাচক ব্রাহ্মণ ছিল । সে মুসলমানীর প্রেমে মজিয়া ধর্ম ত্যাগ করে। এক বৎসর পরে দেখা । তাহার নাম বদলাইয়াছে, পোশাক বদলাইয়াছে, প্রকৃতি বদলাইয়াছে, ভগবানের দেওয়া যে আকৃতি, সে পর্যন্ত বদলাইয়া গিয়াছে যে আর চিনিবার জো নাই । এবং এইটিই একমাত্র উদাহরণ নয় । বস্তির সহিত যাহারই অল্প বিস্তর ঘনিষ্ঠতা আছে, এ কাজ যেখানে প্রতিনিয়তই ঘটিতেছে- তাহারই অপরিজ্ঞাত নয় যে এমনিই বটে! উগ্রতায় পর্যন্ত ইহারা বোধ হয় কোহাটের মুসলমানকেও লজ্জা দিতে পারে। 

অতএব হিন্দুর সমস্যা এই নয় যে , কি করিয়া এই অস্বাভাবিক মিলন সংঘটিত হইবে; হিন্দুর সমস্যা এই যে , কি করিয়া তাহারা সংঘবদ্ধ হইতে পারিবেন এবং হিন্দুধর্মাবলম্বী যে-কোন ব্যাক্তিকেই ছোট জাতি বলিয়া অপমান করিবার দুর্মতি তাহাদের কেমন করিয়া এবং কবে যাইবে। আর সর্বাপেক্ষা বড় সমস্যা – হিন্দুর অন্তরের সত্য কেমন করিয়া তাহার প্রতিদিনের প্রকাশ্য আচরণে পুষ্পের মত বিকশিত হইয়া উঠিবার সুযোগ পাইবে। যাহা ভাবি তাহা বলি না, যাহা বলি তাহা করি না, যাহা করি তাহার স্বীকার পাই না – আত্মার এত বড় দুর্গতি অব্যাহত থাকিতে সমাজগাত্রের অসংখ্য ছিদ্রপথ ভগবান স্বয়ং আসিয়াও রুদ্ধ করিতে পারিবেন না। ইহাই সমস্যা এবং ইহাই কর্তব্য। হিন্দু – মুসলমানের মিলন হইল না। বলিয়া বুক চাপড়াইয়া কাদিয়া বেড়ানই কাজ নয় । নিজেরা কান্না করিলে তবে অন্য পক্ষ হইতে কাদিবার লোক পাওয়া যাইবে । 

হিন্দুস্থান হিন্দুর দেশ । সুতরাং এ দেশকে অধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার দায়িত্ব একা হিন্দুরই । মুসলমান মুখ ফিয়াইয়া আছে তুরস্ক ও আরবের দিকে , এদেশে চিত্ত তাহার নাই। যাহা নাই তাহার জন্য অপেক্ষা করিয়াই বা লাভ কি , এবং তাহাদের বিমুখ কর্ণের পিছু পিছু ভারতের জলবায়ু ও খানিকটা মাটির দোহাই পাড়িয়াই বা কি হইবে ! আজ এই কথাটাই একান্ত করিয়া বুঝিবার প্রয়োজন হইয়াছে যে, এ কাজ শুধু হিন্দুর, আর কাহারও নয়। মুসলমানের সংখ্যা করিয়া চঞ্চল হইবারও আবশ্যকতা নাই । সংখ্যাটাই সংসারে পরম সত্য নয়।ইহার চেয়েও বড় সত্য রহিয়াছে যাহা এক দুই তিন করিয়া মাথা-গণনার হিসাবটাকে হিসেবের মধ্যে গণ্য করে না।

হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে এতক্ষণ যাহা বলিয়াছি তাহা অনেকের কানেই হয়ত তিক্ত ঠেকিবে, কিন্তু সেজন্য চমকাইবারও প্রয়োজন নাই, মাকে দেশদ্রোহী ভাবিবারো হেতু নাই । আমার বক্তব্যেই নয় যে , দুই প্রতিবেশী জাতির মধ্যে একটা সদ্ভাব ও প্রীতির বন্ধন ঘটিলে সে বস্তু আমার মনঃপুত হইবে না। আমার বক্তব্য এই যে, এই জিনিস যদি নাই-ই হয় এবং হওয়ার যদি কোন কিনারা আপাতত চোখে না পড়ে ত এ লইয়া অহরহ আর্তনাদ করিয়া কোন সুবিধা হইবে না। আর না হইলেই যে সর্বনাশ হইয়া গেল, এ মনোভাবের কোন সার্থকতা নাই। অথচ , উপরে নীচে ডাইনে বামে চারিদিক হইতে একই কথা বারংবার শুনিয়া ইহাকে এমনিই সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিয়া বসিয়াছি যে জগতে ইহা ছাড়া যে আমাদের আর কোন গতি আছে, তাহা যেন আর ভাবিতেই পারি না। তাই করিতেছি কি ? না, অত্যাচার অ অনাচারের বিবরণ সকল স্থান হইতে সংগ্রহ করিয়া এই কথাটাই কেবল বলিতেছি তুমি এই আমাকে মারিলে , এই আমার দেবতার হাত-পা ভাঙ্গিলে এই আমার মন্দির ধ্বংশ করিলে , এই আমার মহিলাকে হরণ করিলে , এবং এ সকল তোমার ভারী অন্যায়, ও ইহাতে আমরা যারপরনাই ব্যাথিত হইয়া হাহাকার করিতেছি। এ সকল তুমি না থামাইলে আমরা আর তিষ্ঠিতে পারি না। বাস্তবিক ইহার অধিক আমরা কি কিছু বলি , না করি ? আমরা নিঃসংশয়ে স্থির করিয়াছি যে , যেমন করিয়াই হউক মিলন করিবার ভার আমাদের এবং অত্যাচার নিবারণ করিবার ভার তাহাদের। কিন্তু বস্তুতঃ হওয়া উচিত ঠিক বিপরিত । অত্যাচার থামাইবার ভার গ্রহন করা উচিত নিজেদের এবং হিন্দু-মুসলমান –মিলন বলিয়া যদি কিছু থাকে ত সে সম্পন্ন করিবার ভার দেওয়া উচিত মুসলমানদের ‘পরে।

কিন্তু দেশের মুক্তি হইবে কি করিয়া ? কিন্তু জিজ্ঞাসা করি , মুক্তি কি হয় গোজামিলে? মুক্তি অর্জনের ব্রতে হিন্দু যখন আপনাকে প্রস্তুত করিতে পারিবে, তখন লক্ষ্য করিবারও প্রয়োজন হইবে না, গোটা –কয়েক মুসলমান ইহাতে যোগ দিল কি না। ভারতের মুক্তিতে ভারতীয় মুসলমানের মুক্তি মিলিতে পারে , এ সত্য তাহারা কোনদিনই অকপটে বিশ্বাস করিতে পারিবে না। পারিবে শুধু তখন যখন ধর্মের প্রতি মোহ তাহাদের কমিবে , যখন বুঝিবে যে কোন ধর্মই হউক তাহার গোড়ামি লইয়া গর্ব করার মত এমন লজ্জাকর ব্যাপার , এতবড় বর্বরতা মানুষের আর দ্বিতীয় নাই । কিন্তু সে বুঝার এখনও অনেক বিলম্ব। এবং জগৎসুদ্ধ লোক মিলিয়া মুসলমানদের শিক্ষার ব্যবস্থা না করিলে ইহাদের চোখ খুলিবে কি না সন্দেহ। আর দেশের মুক্তিসংগ্রামে কি দেশসুদ্ধ লোকেই কোমর বাঁধিয়া লাগে? না ইহা সম্ভব , না তাহার প্রয়োজন হয়। আমেরিকা যখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করিয়াছিল তখন দেশের অর্ধেকের বেশি লোকে অ ইংরেজের পক্ষে ছিল । আয়ারল্যান্ডের মুক্তিযজ্ঞে কয়জনে যোগ দিয়াছিল? যে বলশেভিক গভর্নমেন্ট আজ রুশিয়ার শাসনদন্ড পরিচালনা করিতেছে দেশের লোক সংখ্যার অনুপারে সে ত এখনও শতকে একজনও পৌঁছে নাই। মানুষ ত গরু-ঘোড়া নয়, কেবলমাত্র ভীড়ের পরিমাণ দেখিয়াই সত্যাসত্য নির্ধারিত হয় না, হয় শুধু তাহার তপস্যার একাগ্রতার বিচার করিয়া। এই একাগ্র তপস্যার ভার রহিয়াছে দেশের ছেলেদের ‘পরে। হিন্দু –মুসলমান-মিলনের ফন্দি উদ্ভাবন করাও তাহার কাজ নহে, এবং যে-সকল প্রধান রাজনীতিবিদের দল এই ফন্দিটাকে ভারতের একমাত্র ও অদ্বিতীয় বলিয়া চিৎকার করিয়া ফিরিতেছেন তাহাদের পিছনে জয়ধ্বনি করিয়া সময় নষ্ট করিয়া বেড়ানও তাহার কাজ নহে। জগতে অনেক বস্তু আছে যাহাকে ত্যাগ করিয়াই তবে পাওয়া যায়। হিন্দু-মুসলমান –মিলনও সেই জাতীয় বস্তু। মনে হয় , এ আশা নির্বিশেষে ত্যাগ করিয়া কাজে নামিতে পারিলেই হয়ত একদিন এই একান্ত দুষ্প্রাপ্য নিধির সাক্ষাৎ মিলিবে । কারন মিলন তখন শুধু কেবল একার চেষ্টাতেই ঘটিবে না, ঘটিবে উভয়ের আন্তরিক ও সমগ্র বাসনার ফলে ।


Popular posts from this blog

সিরাজুল আলম খান - ব্ল্যাক সোয়ান

মুক্তিযুদ্ধ চলা কালে ট্রেনিং সেন্টারে (ফোল্ডার হাতে) পরিচিতি :  সিরাজুল আলম খান, নোয়াখালীতে ১৯৪১ সালে জন্ম নেয়া এক জন ব্যাক্তি যে বাংলাদেশের জন্মের সাথে জড়িত অত্যান্ত নিবিড় ভাবে। অবিবাহিত একজন মানুষ যাকে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে সম্মক অবহিতজনের কাছে পরিচিত রহস্যপুরুষ হিসাবে, এছাড়া রাজনৈতিক নেতাদের কাছে তিনি পরিচিত তাত্ত্বিক (theorist) হিসাবে। সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় ৭ বছর কারাভোগ করেন। সিরাজুল আলম খান মেধাবী ছাত্র হিসাবে শিক্ষায়তনে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সিরাজুল আলম খানের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রী অঙ্ক শাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেল জীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজ বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গড়ে উঠে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য এবং দক্ষতা। সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের অসকস বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৬-’৯৭ সনে। নি

প্রাগৈতিহাসিক - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

সমস্ত বর্ষাকালটা ভিখু ভয়ানক কষ্ট পাইয়াছে। আষাঢ় মাসের প্রথমে বসন্তপুরের বৈকুণ্ঠ সাহার গদিতে ডাকাতি করিতে গিয়া তাহাদের দলকে - দল ধরা পড়িয়া যায়। এগারজনের মধ্যে কেবল ভিখুই কাঁধে একটা বর্শার খোঁচা খাইয়া পলাইতে পারিয়াছিল। রাতারাতি দশ মাইল দূরের মাথা - ভাঙা পুলটার নিচে পেঁৗছিয়া অর্ধেকটা শরীর কাদায় ডুবাইয়া শরবনের মধ্যে দিনের বেলাটা লুকাইয়া ছিল। রাত্রে আরো ন ক্রোশ পথ হাঁটিয়া একেবারে পেহলাদ বাগ্দীর বাড়ি চিতলপুরে। পেহলাদ তাহাকে আশ্রয় দেয় নাই। কাঁধটা দেখাইয়া বলিয়াছিল , ' ঘাওখান সহজ লয় স্যাঙ্গাত। উটি পাকব। গা ফুলব। জানাজানি হইয়া গেলে আমি কনে যামু ? খুনটো যদি না করতিস _' ' তরেই খুন করতে মন লইতেছে পেহলাদ। ' ' এই জনমে লা , স্যাঙ্গাত। ' বন কাছেই ছিল , মাইল পাঁচেক উত্তরে। ভিখু অগত্যা বনেই আশ্রয় লইল। পেহলাদ নিজে বাঁশ কাটিয়া বনের একটা দুর্গম অংশে সিনজুরি গাছের নিবিড় ঝোপের মধ্যে তাহাকে একটা মাচা বাঁধিয়া দিল। তালপাতা দিয়া একটা