দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হবার পর এর ঘটনা । ৪৫ এর গ্রীষ্মে তেল-আবিব এর রাস্তার পাশের এক ক্যাফেতে বসে সন্ধ্যায় খবরের কাগজ পড়ছেন হায়েম স্লাভিন (haim slavine) । একটা ছোট খবরে তার চোখ আটকে গেল । আগামী কয়েক মাসের ভেতরে আমেরিকার সরকার তার প্রায় নতুন ৭ লাখ অস্ত্র তৈরি করার বিভিন্ন মেশিন স্ক্রাপ করে ফেলবে । স্লাভিন উঠে পরলেন । বাসায় দ্রুত এসে চিঠি লিখলেন ডেভিড বেন-গোরিয়ান এর কাছে । চিঠিতে উল্লেখ্য করেন এমন সুযোগ আর দ্বিতীয়বার আসবে না (is an opportunity that history would not offer twice)।
শুরু হয় ইজরায়েল রাষ্ট্র তৈরির জন্য সামরিক ভিত্তি তৈরির কাজ। ক্ষেপাটে স্লাভিন একাধারে ছিল কেমিস্ট্রি ফিসিক্স আর ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপর অগাধ দক্ষতা । ইংরেজিতে ‘মাস্টার’ বলতে যা বোঝায়। ৪৫ এ ইহুদী হাগানার(Haganah) এর আর্ম প্রোগ্রামে তার অবদান ছিল অসাধারন । দিনে তার পরিচয় পেলেস্টাইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাওয়ার স্টেশনের ডাইরেক্টর। রাতে হাগানার “Mad chemist”. তার নিজের বাসার ছোট রান্না ঘর ছিল তার ল্যাব । সেখানে তৈরি করে টিএনটি ডেটোনেটর, ঘরে তৈরি হ্যান্ড গ্রেনেড।
স্লাভিনের চিঠি বেন-গোরিয়ানের জন্য একটা নতুন রাস্তা তৈরি করে দেয় তার ভবিষ্যত রাষ্ট্রের জন্য অস্ত্র সংগ্রহের । আর কোন চিন্তা না করে স্লাভিনকে বেন-গোরিয়ান নিউ-ইয়র্কে যাত্রা করতে বলেন। একটা চিঠি দেন সাথে , সে সময়ের আমেরিকার সবচেয়ে অভিজাত ধনী এক ইহুদী পরিবারের কর্তার কাছে । প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় নেভাল লেফটেনেন্ট রুডফ্ল জি, সানিবর্ণ যার মননে ২ টা জিনিস সব সময় কাজ করতো এক জায়নিজম অন্যটি তার পারিবারিক কেমিক্যাল ব্যবসা। বেন-গোরিয়ানের চিঠি পাবার পর আমেরিকার সব পরিচিত জায়নিজ নেতাদের একত্রিত করতে থাকেন। এসব নেতাদের আছে সারা আমেরিকা জুরে পরিচিত ও আর্থিক সামর্থ।
এসব নেতাদের সহায়তার উপর ভিত্তি করে স্লাভিনের কাজ শুরু হয় । আমেরিকাতে থাকা কালীন সময়ের বেশির ভাগ সময় স্লাভিন তার হোটেল রুমেই থাকতেন। এ সময় ‘ Technical Machinery ’ নামের এক ম্যাগাজিনের সব আগের ইস্যুগুলো যোগার করে খুটিয়ে খুটিয়ে পড়া শুরু করেন । এই ‘ Technical Machinery ’ ম্যাগাজিন একদিন দৈব্যক্রমে এক নিউজ-স্টেন্ড এ খোজ পান । এসব ম্যাগাজিনের উল্লেখ্য করা সব যন্ত্রপাতির বিশদ বিবরন তিনি প্রায় মুখস্ত করে ফেলেন। এর পর শুরু করেন আমেরিকার জাং ইয়ার্ডে ‘তীর্থযাত্রা’ । বিভিন্ন জাং ইয়ার্ড থেকে কিনতে থাকেন ড্রীল-প্রেস, লেদ মেশিন, গ্রাইন্ডার, বোরার। এসময় নিজেকে পরিচয় দিতে থাকেন মেটাল ডীলার হিসাবে।
আমেরিকার আইন অনুযায়ী যেসব যন্ত্র অস্ত্র তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয় তা বাতিল করার সময় অবশ্যই ডিসমেন্টাল (Dismantle ) এর সময় একই জায়গাতে না ফেলে বিভিন্ন জায়গাতে ফেলতে হবে। স্লাভিন সব পার্ট একত্র করার জন্য এক দল টোকাই (scavengers) নিয়োগ করেন। তারা দেশের বিভিন্ন জাং ইয়ার্ড থেকে যোগার করতে থাকে সব যন্ত্রপাতি ও তার অবশেষ। এসব জোগার করে জমা হতে থাকে স্লাভিনের ২০০০ পার্ক এভিনিউ এর এক পরিত্যাক্ত ডেইরি ফার্মে।
স্লাভিনের গন্ধমাধব সম ধ্বংসাবশেষ কেনা শেষে যা দাঁড়ায় তা দিয়ে দিনে প্রায় ৫০ হাজার বন্দুক বা মেশিনগানের গুলি তৈরি করার মত ক্ষমতা আছে। ১৫০০ অপারেশনের এসেম্বলী লাইন তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় সব মেশিন। ৮১ মিলি মর্টার শেল তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। এসব কিছু কেনার জন্য স্লাভিনের সে সময় খরচ হয় ২ মিলিয়ন ডলার, যদি এসব স্ক্রাপ হিসাবে না কিনে মেশিন হিসাবে কেনা হতো তবে খরচ হতো ৭০ মিলিয়ন।
কেনা শেষে পেলেস্টাইনে পাঠানো ছিল আরেক বড় চ্যালেঞ্জ। স্লাভিন এ কাজের জন্য সব মেশিনের শেষ নাট বোল্ট পর্যন্ত খুলে ফেলেন। সব খোলা হলে দেখা যায় ৭৫০০০ আলাদা আলাদা পিস তৈরি হয়েছে । স্লাভিন নিজের তৈরি করা কোডিং সিস্টেমের মাধ্যমে প্রতিটাকে চিহ্নিত করেন। তার পর সব অত্যান্ত রেন্ডম ভাবে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করা হয় । সব মিলিয়ে ৩৫ টনের মালামাল টেক্সটাইল মেশিনারির নামে পেলেস্টাইনে পাঠানোর ব্যাবস্থা করা হয় এক আরবীয় ব্যবসায়ীর ভুয়া অফিসিয়াল পারমিটের বিপরিতে। জিনিসগুলো এতো বেশি এলোমেলো করে শিপমেন্ট এর জন্য প্যাকিং করা হয় যে শুধু মাত্র ‘ইঞ্জিনিয়ারিং জিনিয়াস’ এর পক্ষেই সম্ভব ছিল এ জিনিস বুজতে পারা যে এগুলো অস্ত্র তৈরির যন্ত্র। বাক্স এর পর বাক্স ব্রিটিশ কাস্টমসের এর দেয়াল পার হয়ে প্রবেশ করতে থাকে পেলেস্টাইনে। অবশ্য বিপদ মুক্ত রাখার জন্য কাস্টমস কে ঘুস দেয়া হয় প্রায় ২৫ হাজার ডলার।
এসব বাক্স বিভিন্ন কিবুতজিম(Kibbutzim) এ লুকিয়ে রাখা হয় । জাতিসংঘের ২৯ নভেম্বর রাতে সাধারন পরিসদে ভোটাভোটির মাধ্যমে পেলেস্টাইন ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়। অন্যদিকে ব্রিটিশদের পেলেস্টাইন ছাড়ার সময় নির্ধারন হয় ১৫ মে ১৯৪৮ । এসময় ইহুদী নেতারা এক ডিলেমা তে পড়ে যায় । ব্রিটিশ যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন নাকি প্রোডাক্সন শুরু করবেন । যদি প্রোডাক্সন শুরু করে তবে সম্ভাবনা থাকে তা ব্রিটিশদের দ্বারা আবিষ্কার হবার ও বাজেয়াপ্ত হবার ।
ইহুদী নেতারা এ ঝুকি না নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। যখন এ সব মেশিন আবার এসেম্বল করা হয় ৭৫০০০ পিস থেকে একটা নাট একটা বোল্ট বা একটা ওয়াশার ও হারানো যায় নি ।