Skip to main content

জেনিসারি





অটোম্যান সাম্রাজ্যের সুলতান মুরাদ নতুন এক পদাতিক সৈন্যদল তৈরি করার চিন্তা করছেন, ১৪শ শতকের ঘটনা । সে সময় সুলতানের দেহরক্ষী ও প্রাসাদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল সাধারন সৈন্যদের থেকে নেয়া সৈন্য। যাদের অনুগত্য সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহ থেকে যেতো যেহেতু তারা আসতো বিভিন্ন গোত্র থেকে যেখানে প্রধানের প্রতি আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। তাই এ নতুন সেনাদলের চিন্তা । এদের পরিচয়, এরা Janissary তুর্কি ভাষায় ইয়াসিসিন, হাসিসিন এর মতই এ সেনাদল ইতিহাসে অনেক বিস্বয় তৈরি করে ইতিহাসে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

এই জেনিসারি সৈন্যদের সংগ্রহ করা হতো তুর্কি নয় এমন পরিবার থেকে Devsirme প্রথার মাধ্যমে । মূলত বলকান অঞ্চলের খ্রিস্টান পরিবার থেকে থেকে এদের সংগ্রহ করা হতো । পরবর্তী সময়ে আলবেনিয়া, গ্রীস, বজনিয়া, সার্বিয়া, ক্রোয়াট, বুলগেরিয়া ও রাশিয়ার দক্ষিন অংশ থেকে । জেনিসারির প্রকৃত ধরন যদি দেখা হয় তবে দেখা যাবে যে তারা আসলে সম্রাটের দাস, তবে যে দাসেরা মাসে মাসে বেতন পেতো , অবসর ভাতা পেত। বিয়ে করার অনুমতি ছিল তাদের। নিয়োগের সময় সাধারনত এদের বয়েস হতো ৮ থেকে ১৮, যদিও অনেক কম বয়েসেই এদের নিয়োগ করা হতো। প্রতি ৫ বছর পর পর তুর্কি প্রশাসনের লোকজন তাদের এলাকা খুজে নিয়ে আসতেন সব খ্রিস্টান ছেলেদের , তাদের থেকে বাছাই করা হতো সবচেয়ে শক্তিশালীদের। তারপর তাদের পাঠিয়ে দেয়া হতো বিভিন্ন তুর্কি পরিবারে তুর্কি ভাষা, সংস্কৃতি ও ইসলাম সম্পর্কে শেখার জন্য। এসব শেষে তাদের নিয়োগ দেয়া হতো জেনিসারি ট্রেনিং এর জন্য। এ সময় ইসলামী রীতিনীতি শেখানো হতো অত্যান্ত শক্ত ভাবে।  এসময় তাদের ২৪ ঘন্টা নিয়মের ভেতর দিনে যেতে হতো। তবে তাদের দাড়ি রাখার কোন অনুমতি ছিল না। তাদের দক্ষতা অনুযায়ী তাদের ইঞ্জিনিয়ারিং, শিল্পকলা , বরকন্দাজ, তীরন্দাজ, আর্টীলারি। সে সময়ের অনেক খ্রিস্টান পরিবার তাদের সন্তানদের এই জেনিসারিতে নিয়োগের জন্য তদবির করতো। অবশ্য অনেকে অনাগ্রহী ছিল জেনিসারিতে নিয়োগের ব্যাপারে। সে সময় জেনিসারিতে নিয়োগের অর্থ ছিল successful career and comfort’ কারন জেনিসারিতে যারা ছিল তাদের প্রাদেশিক গভর্নর পর্যন্ত হতে পারতো। তুর্কি সাম্রাজের অনেক চরিত্র যারা আসলে ছিলেন জেনিসারি।

 Devsirme  প্রথার মাধ্যমে মূলত অটোম্যান সাম্রাজের দ্রুত বর্ধনশীল রাজনৈতিক সামরিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে দক্ষ জন শক্তির অভাব তৈরি হয়েছিল তার পূরনের একটা প্রচেষ্টা । নিয়োগের সময় কিছু জিনিস খেয়াল রাখা হতো
১. সম্ভাব্য প্রার্থী যেন এতিম না হয়।
২. পরিবারের এক মাত্র সন্তান না হয়।
৩. সম্ভাব্য প্রার্থী যেন নিয়োগের আগে পর্যন্ত তার্কিস ভাষা না জেনে থাকে ।
৪. সম্ভাব্য প্রার্থী যেন কোন ট্রেড কাজ না শিখে থাকে ।

জেনিসারি ছিল সেসময়ের প্রথম সামরিক দল যারা নিজস্ব ইউনিফর্ম ব্যবহার করতো। যারা নিয়মিত বেতন পেত, যারা মূলত অগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতো, তাদের জন্য ছিল থাকার আলাদা ব্যবস্থা বা ব্যারাক। মূলত আধুনিক সেনাদলের যে সব বৈশিষ্ট্য থাকে তা শুরু হয় এ জেনিসারিদের মাধ্যমে। সে সময় সাধারনত সৈন্যদের শুধু মাত্র যুদ্ধকালীন সময় বেতন দেয়া হতো কিন্তু জেনিসারিরা সেমময় নিয়মিত ৩ মাস অন্তর অন্তর বেতন পেতো, এছাড়া যুদ্ধের জেতার অংশ হিসাবে গনিমত এর অংশ পেতো। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তারা সে সময়ের অন্যে যে কোন সেনা দলের থেকে বেশি সুযোগ সুবিধা পেত। তাদের মাঝে দায়িত্ব ভাগ করা থাকতো কারা সব অস্ত্র বহন করবে , কারা তাবু টানাবে , কারা মেডিকেল সাপোর্ট দিবে।

সুলতান মুরাদ থেকে শুরু করে মুরাদ দ্বিতীয় পর্যন্ত জেনিসারিরা অটোম্যান সাম্রাজ্যের সেনাদের গুরুত্বপুর্ন অংশ হিসাবে কাজ করে । মুরাদ দ্বিতীয় এর সময় ১৬৮০ সালে জেনিসারি প্রথা বাতিল করা হয়। জেনিসারিরা বুঝতে শুরু করে তাদের গুরুত্ব এবং প্রায়সই তারা সরকারের কাজে প্রভাবিত করা শুরু করে, এসময় তারা পূর্বের জেনিসারিদের সন্তানদের নতুন করে নিয়োগের প্রভাবিত করতে থাকে , জোরপূর্বক অর্থ সংগ্রহ করতে থাকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে । ১৬২২ সালের দিকে এসে জেনিসারিরা সম্রাটের জন্য সমস্যা হিসাবে তৈরি হয় , এসময় থেকে জেনিসারিদের সর্বক্ষেত্র প্রভাব বিস্তার এতোটাই বেশি ছিল যে ক্ষেত্র বিশেষে বিভিন্ন যুদ্ধ, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কে নিজেদের সুবিধা মত পরিবর্তন করাতো। মুরাদ দ্বিতীয় যখন ক্ষমতায় আসেন তখন জেনিসারিরা তার জন্য বড় ধরনের ঝুকি হিসাবে ছিল। তারা বেতন বৃদ্ধি, ক্ষমতার অপব্যবহার , সামরিক শক্তির অপব্যবহার ও সেনা আধুনিকায়নের পথে বাধা হিসাবে কাজ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রন রক্ষ করতে চাইছিল। এতে ১৩৫০০০ জেনিসারি
(যাদের অধিকাংশ ভূয়া) নিয়ে সম্রাটের মাথা ব্যাথ্যার কারন হয়ে দাঁড়ায়। 

বাধ্য হয়ে সম্রাট মুরাদকে নতুন পথ ধরতে হয়। তিনি এক ফতোয়ার মাধ্যমে এক নতুন সেনা দল গঠনের কথা বলেন। এতে জেনিসারিদের মাঝে বিদ্রোহ দেখা দেয় । এই সুযোগে তাদের ব্যারাকে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়, যাতে প্রায় ৪০০০ সেনা মারা যায় বাকিদের হত্যা বা দেশান্তরী করা হয়। তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়। এই ঘটনাকে the Auspicious Incident হিসাবে পরিচিত। যারা পালিয়ে চলে যায় নিজ নিজ অঞ্চলে , পরবর্তী সময়ে তারাই অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করেছিল।

Popular posts from this blog

সিরাজুল আলম খান - ব্ল্যাক সোয়ান

মুক্তিযুদ্ধ চলা কালে ট্রেনিং সেন্টারে (ফোল্ডার হাতে) পরিচিতি :  সিরাজুল আলম খান, নোয়াখালীতে ১৯৪১ সালে জন্ম নেয়া এক জন ব্যাক্তি যে বাংলাদেশের জন্মের সাথে জড়িত অত্যান্ত নিবিড় ভাবে। অবিবাহিত একজন মানুষ যাকে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে সম্মক অবহিতজনের কাছে পরিচিত রহস্যপুরুষ হিসাবে, এছাড়া রাজনৈতিক নেতাদের কাছে তিনি পরিচিত তাত্ত্বিক (theorist) হিসাবে। সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় ৭ বছর কারাভোগ করেন। সিরাজুল আলম খান মেধাবী ছাত্র হিসাবে শিক্ষায়তনে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সিরাজুল আলম খানের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রী অঙ্ক শাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেল জীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজ বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গড়ে উঠে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য এবং দক্ষতা। সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের অসকস বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৬-’৯৭ সনে। নি

প্রাগৈতিহাসিক - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

সমস্ত বর্ষাকালটা ভিখু ভয়ানক কষ্ট পাইয়াছে। আষাঢ় মাসের প্রথমে বসন্তপুরের বৈকুণ্ঠ সাহার গদিতে ডাকাতি করিতে গিয়া তাহাদের দলকে - দল ধরা পড়িয়া যায়। এগারজনের মধ্যে কেবল ভিখুই কাঁধে একটা বর্শার খোঁচা খাইয়া পলাইতে পারিয়াছিল। রাতারাতি দশ মাইল দূরের মাথা - ভাঙা পুলটার নিচে পেঁৗছিয়া অর্ধেকটা শরীর কাদায় ডুবাইয়া শরবনের মধ্যে দিনের বেলাটা লুকাইয়া ছিল। রাত্রে আরো ন ক্রোশ পথ হাঁটিয়া একেবারে পেহলাদ বাগ্দীর বাড়ি চিতলপুরে। পেহলাদ তাহাকে আশ্রয় দেয় নাই। কাঁধটা দেখাইয়া বলিয়াছিল , ' ঘাওখান সহজ লয় স্যাঙ্গাত। উটি পাকব। গা ফুলব। জানাজানি হইয়া গেলে আমি কনে যামু ? খুনটো যদি না করতিস _' ' তরেই খুন করতে মন লইতেছে পেহলাদ। ' ' এই জনমে লা , স্যাঙ্গাত। ' বন কাছেই ছিল , মাইল পাঁচেক উত্তরে। ভিখু অগত্যা বনেই আশ্রয় লইল। পেহলাদ নিজে বাঁশ কাটিয়া বনের একটা দুর্গম অংশে সিনজুরি গাছের নিবিড় ঝোপের মধ্যে তাহাকে একটা মাচা বাঁধিয়া দিল। তালপাতা দিয়া একটা

বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা

১৯২৬ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটি ভাষন দেন যার নাম “বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা” । এটি বাঙলা প্রাদেশিক সম্মেলনে প্রদান করেন। পরে তা হিন্দু সংঘ পত্রিকায় ছাপা হয় ১৯ শে আশ্বিন ১৯৩৩ সালে। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক  এর ভাষায় ১৯৩০ সালের দিকে প্রকাশিত শরৎচন্দ্রের বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা পর এত ( আহামদ ছফার বাঙালি মুসলমানের মন ) প্রভোক্যাটিভ রচনা বাংলা ভাষায় পড়ি নাই। কোন একটা কথা বহু লোকে মিলিয়া বহু আস্ফালন করিয়া বলিতে থাকিলেই কেবল বলার জোরেই তাহা সত্য হইয়া উঠে না । অথচ এই সম্মিলিত প্রবল কন্ঠস্বরের একটা শক্তি আছে । এবং মোহও কম নাই । চারিদিক গমগম করিতে থাকে – এবং এই বাস্পাচ্ছন্ন আকাশের নীচে দুই কানের মধ্যে নিরন্তর যাহা প্রবেশ করে , মানুষ অভিভূতের মতো তাহাকেই সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিয়া বসে । propaganda বস্তুত এই-ই । বিগত মহাযুদ্ধের দিনে পরস্পরের গলা কাটিয়া বেড়ানই যে মানুষের একমাত্র ধর্ম ও কর্তব্য , এই অসত্যকে সত্য বলিয়া যে দুই পক্ষের লোকেই মানিয়া লইয়াছিল , সে ত কেবল অনেক কলম এবং অনেক গলার সমবেত চীৎকারের ফলেই । যে দুই- একজন প্রতিবাদ করিতে গিয়াছিল , আসল কথা