Skip to main content

বাংলাদেশের উৎসব

আমার এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করলো বাংলাদেশের একদম নিজস্ব সংস্কৃতিক উৎসব একটা নাম বল , যেটা শুধু বাংলাদেশেই পালন করা হয় । যেটা বিদেশী কোন উৎস হতে আসে নাই । একটার নাম বল ...সত্যিকার অর্থে আমি ধাধায় পরে গেছিলাম । হাসিরচ্ছলে উত্তর দিলাম পয়েলা বৈশাখ , কিন্তু মনের মাঝে তখন খচখচ করছিল আকবর এর নাম । 

অনেক কিছুই আসলে অন্য জায়গা থেকে আসা । আমাদের নববর্ষ সেটা আকবর সাহেবের প্রচলন করা , পুরান ঢাকার সাকরাইন এর প্রচলন মোগল আমলে ৭৪০ সালে নবাব নাজিম মহম্মদ খাঁ এর প্রচলন করেন । ইদ এর প্রচলন ধর্মীয় উৎস থেকে, পুজার উৎস ধর্ম । 

আসলে খুব চিন্তায় পরে গেলাম । এমন কি কি উৎসব আছে যা বাংলাদেশে প্রচলন আর বাংলাদেশ থেকে অন্য দিকে বিস্তার লাভ করেছে ...



চিন্তা করতে গিয়ে পেলাম জব্বারের বলি খেলা । এটা হয়তো শুধু চট্রগ্রামেই হয় , ১৯০৯ এ এর জন্ম এবং এর পর থেকেই প্রতিবছর উৎসব করে এ খেলা হয় । এর জন্ম ইতিহাস খুজতে গিয়ে পেলাম "বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন।"

এর পর মনে হলো নৌকা বাইচ এর কথা । এটাও এই অঞ্চলের লোকাল প্রোডাক্ট হতে পারে । নদনদী পানি ছাড়া এই জিনিস সম্ভব না । ইতিহাস বলে বাংলার ১২ ভূইয়াদের নৌবাহিনিতে বিশেষ ধরনের নৌকা থাকতো যার সামনের অংশ(গুলুই) হতো ২-৩ তালা সমান উচু যাতে কোন দুর্গে নৌকা লাগিয়ে দ্রুত সৈন্যরা উঠে যেতে পারে । আর যাই হোক পাঞ্জাব নদী থাকার পরেও বাংলাদেশে ৭১ এ যেভাবে পাঞ্জাবীরা হাটুপানিতে ডুবে মরছে তাতে এইটা বিশ্বাস করার কোন কারন নাই এই জিনিস ইম্পোর্ট করা । ইতিহাসের পাতা ঘেটে যা দেখলাম তা হচ্ছে "বাইচ" শব্দটির ব্যুৎপত্তি বিবেচনা করে অনুমিত হয়েছে যে মধ্যযুগের মুসলমান নবাব, সুবেদার, ভূস্বামীরা, যাদের নৌবাহিনী, তারা এই প্রতিযোগিতামূলক বিনোদনের সূত্রপাত করেছিলেন। তবে এ বিষয়ে দুটি জনশ্রুতি আছে।

  • একটি জনশ্রুতি জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রাকে কেন্দ্র করে। জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রার সময় স্নানার্থীদের নিয়ে বহু নৌকার ছড়াছড়ি ও দৌড়াদৌড়ি পড়ে যায়। এতেই মাঝি-মাল্লা-যাত্রীরা প্রতিযোগিতার আনন্দ পায়। এ থেকে কালক্রমে নৌকাবাইচের শুরু।
  • দ্বিতীয় জনশ্রুতি পীরগাজীকে কেন্দ্র করে। আঠার শতকের শুরুর দিকে কোন এক গাজী পীর মেঘনা নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়ে অন্য পাড়ে থাকা তা ভক্তদের কাছে আসার আহ্বান করেন। কিন্তু ঘাটে কোন নৌকা ছিল না। ভক্তরা তার কাছে আসতে একটি ডিঙ্গি নৌকা খুঁজে বের করেন। যখনই নৌকাটি মাঝ নদীতে এলো তখনই নদীতে তোলপাড় আরম্ভ হল। নদী ফুলে ফেঁপে উঠলো। তখন চারপাশের যত নৌকা ছিল তারা খবর পেয়ে ছুটে আসেন। তখন সারি সারি নৌকা একে অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলে। এ থেকেই নৌকা বাইচের গোড়াপত্তন হয়।

বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি অনুযায়ী নদনদী পানির উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি দক্ষিন বাংলাতে , উত্তরবঙ্গ বা রাঢ়বঙ্গের নদনদীর সংখ্যা একদিকে যেমন কম তেমনি সেগুলো প্রশস্থতাও অনেক অনেক বেশি যা জনসমাগম তৈরি হবার জন্য উপযোগি না । ফলে বাংলাদেশের বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশাল খুলনা এলাকাতেই নৌকা বাইচের প্রচলন ও উপস্থিতিটা চোখে পরার মত ।

এরপর ধরা যায় ২১ ফেব্রুয়ারির কথা , ৫৩ থেকে এই কালচার শুরু হয় বাংলাদেশে। হতে পারে এর সাথে রাজনীতি জড়িত , মানুষের মৃত্যু জড়িত , তবে এর থিম এর ইউনিকনেস এর কারনে সারা বিশ্বেই এখন পালন করছে এই ভাষা আন্দোলন দিবস/শহীদ দিবস , আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ।

২ বাংলা মিলায়ে যদি উতসবের কথা বলা হয় তো প্রথমের আসে রাখি বন্ধন উৎসব এর কথা । যার প্রচলন রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে ১৯০৫ এর পরে । বাংলা ভাগ হয় ১৯০৫-এ,এর প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ‘রাখিবন্ধনের দিন পরস্পরের হাতে হরিদ্রা বর্ণের সূত্র’ বাঁধার আহ্বান জানালেন। লিখলেন রাখি-সংগীত। 

রবীন্দ্রনাথ ১৭ সেপ্টেম্বর সাবিত্রী লাইব্রেরীর সভায় রাখীবন্ধনের প্রস্তাব রেখেছিলেন। জনসাধারণ উৎসাহের সঙ্গে রাখীবন্ধন কর্মসূচিটি গ্রহণ করে। বেঙ্গলী পত্রিকায় রাখী সংক্রান্ত ব্যবস্থা নামে একটি ঘোষণা ছাপা হয়েছিল—দিন। এই বৎসর ৩০ শে আশ্বিন ১৬ অক্টোবর আগামী বৎসর হইতে আশ্বিনের সংক্রান্তি।
ক্ষণ। সূর্য্যোদয় হইতে রাত্রির প্রথম প্রহর পর্যন্ত।
নিয়ম। উক্ত সময়ে সংযম পালন।
উপকরণ। হরিদ্রাবর্ণের তিন সুতার রাখী।
মন্ত্র। ভাই ভাই এক ঠাঁই, ভেদ নাই ভেদ নাই।
অনুষ্ঠান। উচ্চ নিচ হিন্দু মুসলমান, খৃস্টান বিচার না করিয়া ইচ্ছামত বাঙ্গালী মাত্রেই হাতে রাখী বাঁধা, অনুপস্থিত ব্যক্তিকে সঙ্গে মন্ত্রটি লিখিয়া ডাকে অথবা লোকের হাতে রাখী পাঠাইলেও চলিবে।১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। সেদিন কোলকাতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, ৩০ শে আশ্বিন প্রভাতে রবীন্দ্রনাথকে পুরোভাগে রাখিয়া বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আপামর জনসাধারণ এক বিরাট শোভাযাত্রা করিয়া গঙ্গাতীরে সমবেত হইল। গঙ্গাস্নান করিয়া পরস্পরের হস্তে রাখী বন্ধন করিল। রবীন্দ্রনাথ সজনীকান্ত দাশকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সামনে যাকে পেতাম, তারই হাতে বাঁধতাম রাখি। সরকারী পুলিস এবং কনস্টেবলদেরও বাদ দিতাম না।

যা পরে সারা ভারতে ও পরে বিশ্বে অন্য নামে/থিমে প্রচলন হয় (নাম/থিম পরিবর্তনের কারন আছে , তারা আমাদের মত ভাইবইন বানানির থেকে ফ্রেন্ড বানানিতে বিশ্বাস রাখে , আফটার অল পরের ধাপে বিছানার কমফোর্টের প্রশ্ন জড়িত )।

এছাড়া নবান্ন, চরকমেলার মত আরো কিছু স্বল্প পরিচিত কিছু উৎসব আছে ... স্বল্প পরিচিত বলার কারন এর প্রচলন বা চর্চা এখনো নাগরিক সমাজে এসে পৌছেনি বা এখনো গ্রামীন সমাজেই এর মর্ম প্রচলিত । 

শেষে আরেকটি কথা বলি বঙ্গাব্দ নিয়ে , বঙ্গাব্দের ১২ মাসের নাম গুলো দেখেছেন ??? আকবর যদি বাংলাসন প্রচলন করে থাকতেন তবে ২ একটা নাম কি আরবি ফার্সি হতে পারতো না ??? কেন হয়নি সেটা নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায় আকবরের আগেই এই অঞ্চলে বেশ অনেক গুলো পঞ্জিকার প্রচলন ছিল, যেমন - মল্লাব্দ , শকান্দ, লক্ষনাব্দ, পালাব্দ, নশরত, শাহী সন, চৈতন্যাব্দ । ধারনা করা হয় শকাব্দের পরিমার্জিত রুপ আকবর ব্যবহার করেন খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য । শকাব্দের বৎসর শুরু হতো অগ্রহায়ন দিয়ে । কিন্তু সে ফসল মাঠেই থাকার জন্য খাজনা আদায় করা সম্ভব ছিল না ।
আরো বিস্তারিত বাংলা সন সম্পর্কে জানতে এ লিঙ্ক দেখতে পারেন বাংলাসন ।

Popular posts from this blog

সিরাজুল আলম খান - ব্ল্যাক সোয়ান

মুক্তিযুদ্ধ চলা কালে ট্রেনিং সেন্টারে (ফোল্ডার হাতে) পরিচিতি :  সিরাজুল আলম খান, নোয়াখালীতে ১৯৪১ সালে জন্ম নেয়া এক জন ব্যাক্তি যে বাংলাদেশের জন্মের সাথে জড়িত অত্যান্ত নিবিড় ভাবে। অবিবাহিত একজন মানুষ যাকে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে সম্মক অবহিতজনের কাছে পরিচিত রহস্যপুরুষ হিসাবে, এছাড়া রাজনৈতিক নেতাদের কাছে তিনি পরিচিত তাত্ত্বিক (theorist) হিসাবে। সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় ৭ বছর কারাভোগ করেন। সিরাজুল আলম খান মেধাবী ছাত্র হিসাবে শিক্ষায়তনে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সিরাজুল আলম খানের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রী অঙ্ক শাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেল জীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজ বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গড়ে উঠে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য এবং দক্ষতা। সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের অসকস বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৬-’৯৭ সনে। নি

প্রাগৈতিহাসিক - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

সমস্ত বর্ষাকালটা ভিখু ভয়ানক কষ্ট পাইয়াছে। আষাঢ় মাসের প্রথমে বসন্তপুরের বৈকুণ্ঠ সাহার গদিতে ডাকাতি করিতে গিয়া তাহাদের দলকে - দল ধরা পড়িয়া যায়। এগারজনের মধ্যে কেবল ভিখুই কাঁধে একটা বর্শার খোঁচা খাইয়া পলাইতে পারিয়াছিল। রাতারাতি দশ মাইল দূরের মাথা - ভাঙা পুলটার নিচে পেঁৗছিয়া অর্ধেকটা শরীর কাদায় ডুবাইয়া শরবনের মধ্যে দিনের বেলাটা লুকাইয়া ছিল। রাত্রে আরো ন ক্রোশ পথ হাঁটিয়া একেবারে পেহলাদ বাগ্দীর বাড়ি চিতলপুরে। পেহলাদ তাহাকে আশ্রয় দেয় নাই। কাঁধটা দেখাইয়া বলিয়াছিল , ' ঘাওখান সহজ লয় স্যাঙ্গাত। উটি পাকব। গা ফুলব। জানাজানি হইয়া গেলে আমি কনে যামু ? খুনটো যদি না করতিস _' ' তরেই খুন করতে মন লইতেছে পেহলাদ। ' ' এই জনমে লা , স্যাঙ্গাত। ' বন কাছেই ছিল , মাইল পাঁচেক উত্তরে। ভিখু অগত্যা বনেই আশ্রয় লইল। পেহলাদ নিজে বাঁশ কাটিয়া বনের একটা দুর্গম অংশে সিনজুরি গাছের নিবিড় ঝোপের মধ্যে তাহাকে একটা মাচা বাঁধিয়া দিল। তালপাতা দিয়া একটা

বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা

১৯২৬ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটি ভাষন দেন যার নাম “বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা” । এটি বাঙলা প্রাদেশিক সম্মেলনে প্রদান করেন। পরে তা হিন্দু সংঘ পত্রিকায় ছাপা হয় ১৯ শে আশ্বিন ১৯৩৩ সালে। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক  এর ভাষায় ১৯৩০ সালের দিকে প্রকাশিত শরৎচন্দ্রের বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা পর এত ( আহামদ ছফার বাঙালি মুসলমানের মন ) প্রভোক্যাটিভ রচনা বাংলা ভাষায় পড়ি নাই। কোন একটা কথা বহু লোকে মিলিয়া বহু আস্ফালন করিয়া বলিতে থাকিলেই কেবল বলার জোরেই তাহা সত্য হইয়া উঠে না । অথচ এই সম্মিলিত প্রবল কন্ঠস্বরের একটা শক্তি আছে । এবং মোহও কম নাই । চারিদিক গমগম করিতে থাকে – এবং এই বাস্পাচ্ছন্ন আকাশের নীচে দুই কানের মধ্যে নিরন্তর যাহা প্রবেশ করে , মানুষ অভিভূতের মতো তাহাকেই সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিয়া বসে । propaganda বস্তুত এই-ই । বিগত মহাযুদ্ধের দিনে পরস্পরের গলা কাটিয়া বেড়ানই যে মানুষের একমাত্র ধর্ম ও কর্তব্য , এই অসত্যকে সত্য বলিয়া যে দুই পক্ষের লোকেই মানিয়া লইয়াছিল , সে ত কেবল অনেক কলম এবং অনেক গলার সমবেত চীৎকারের ফলেই । যে দুই- একজন প্রতিবাদ করিতে গিয়াছিল , আসল কথা