১৮০০ এর শেষের দিকে এসে কলকাতায় একটি ঘটনা প্রচন্ড আলোরণ তোলে । নবীন নামক এক সম্ভ্রান্ত বংশের সরকারি কর্মচারীর স্ত্রীর সাথে শিবমন্দিরের প্রধান পুরোহিত বা মহন্তের পরকীয়া ও তৎপরবর্তী নবীন এর হাতে স্ত্রী এলোকেশির হত্যা ঘটে । সে সময়কার কলকাতার জনসমাজে এ ঘটনার প্রভাব অবিশ্বাস্য। সে সময় সে ঘটনা নিয়ে যাত্রাপালা , কবিগান, কালিঘাটের পটেরচিত্র তৈরি হয়েছিল। সে সময় ইংরেজ সরকারের বিচারে নবীন ও মহন্তের জেল হয়েছিল । কিন্তু জনগনের প্রবল আপত্তি ও দাবির মুখে সে সময় নবীন চন্দ্রকে ২ বছর পরে মুক্তি দেয়া হয় ।
এ ঘটনার সাথে নারীর ও শাড়ীর সম্পর্ক কি সেটা আসলেই ভাবনার বিষয় । আগের প্যারায় উল্লেখ করেছি যে সময় এ ঘটনা নিয়ে পটের চিত্র তৈরি হয়েছিল । যারা পটের চিত্র সম্পর্কে জানেন তারা ভাল করেই বুঝবেন ব্যাপারটা । যারা জানেন না তাদের জন্য বলছি, পটের চিত্র হচ্ছে বর্তনামের রিক্সা আর্টের যে ধারা বাংলাদেশে আছে তা এই পটের চিত্রের সাথে পাকিস্তানি ও সামান্য পাশ্চাত্য ঘরানার সংমিশ্রনে তৈরি । পটের চিত্রে ফিগার মূলত দ্বি মাত্রিক আকারে আকা হয় । কলকাতার যামিনি রায় এর আকা ছবি গুলো দেখলে পটেরচিত্রের ধারনা অনেকখানি স্বচ্ছ হবে । যদিও যামিনি রায় ছবি আকার ক্ষেত্রে অনেক নতুন সংযোজন করেছেন তবে তার ছবি আকার ক্ষেত্রে মূল ভাবনাটা পটের চিত্রের আকার স্টাইল এর উপর ভিত্তি করেই।
যা হোক পটেরচিত্রের কথা আসার কারন সেখানে পাত্র পাত্রীদের পোষাক । সে সময় বাঙ্গালী জনসমাজের পরিচত পোষাকেই পটের চিত্রের পাত্রপাত্রীদের উপস্থাপন করা হয়েছে । আর এক্ষেত্রে তৎকালীন পোষাকের একটা ভাল রেফারেন্স হিসাবেই পটের চিত্রের গুরুত্ব রয়েছে । যেমনটা রয়েছে মোগল ঘারানার চিত্রশিল্পের মোগলদের অন্তপুরের বৈশিষ্ট্য জানার ক্ষেত্রে । সে সময়ের এর মহন্ত এলোকেশী পটের চিত্রগুলোর মাঝে অনেক গুলোই সংরক্ষন আছে এন্টিক হিসাবে । হয়তো বেস্ট সেলার হবার সুবাদেই এই অবিনাশী থাকা । এ সিরিজ এর চিত্রগুলো দেখলে দেখা যায় যে এলোকেশী বা তার সাথের বিভিন্ন নারী চরিত্রের বাহারি শাড়ী , গহনার আধিক্য থাকলেও কেউ ব্লাউজ নামক কোন পোষাক পরেনি । এছাড়া সে সময়কার অনেক ছবি যা ইউরোপিয়ানদের আকা তাতেও ব্লাউজ এর কোন উপস্থিতি পাওয়া যায় না । যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে কাচুলি । যা হচ্ছে এক খন্ড কাপড়কে বুকে পেচিয়ে নেয়া বা পিঠে গিঠ দিয়ে বক্ষ বন্ধনির মত করে ব্যবহার করা ।
ইহিতাস এর বইতে বা বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিচারনে যা পাওয়া যায় তা বরং অনেক বেশি বিশ্বয়কর । এক সময় পায়ে জুতা পরা ছিল মেয়েদের জন্য আসম্মানের , সে সময় জুতা পরতো শুধুমাত্র বাইজিরা । সে সময়ের ইতিহাসে লাখনৌ মাদ্রাজ থেকে আসা বাইজিদের উপস্থিতি প্রচুর পাওয়া যায় । অবাঙ্গালী এ সব নারীদের পোষাকের ভিন্নতাও ছিল । পরবর্তী সময়ে এ অঞ্চলের মেয়েরা বাইজি পেষায় আসা শুরু করে , তারা লাখনৌ এর বাইজি নারীদের মত নাম , পোষাক, আচরন ও গ্রহন করে । তবে সব কি আর গ্রহন করায় সম্ভব হয় । মুন্নুজান এর বদলে চামেলি বাই এর উত্থান হয় । লাখনৌ এর মুন্নুজান এর পোষাক চোলি ঘাগরা এর জায়গাতে ঘগরা ঠিক থেকে চোলি ছোট হয়ে যায় ।
ব্লাউজ নামের পোষাক এর উপস্থিতি বাঙ্গালী সমাজে পাওয়া যায় ঠাকুর বাড়ির ইতিহাস থেকে । বাংলার অনেক কিছুই দিয়ে গেছে কলকাতার ঠাকুর বাড়ী । একদিকে যেমন রবীন্দ্রনাথ তেমনি নারীদের পোষাক , ভদ্রলোক কালচার …। বাঙ্গালীদের এমন অনেক কিছুই আছে যার শুরুটা এই ঠাকুর বাড়ীর হাত ধরে । ঠাকুর বাড়ির নারীরাই প্রথম ব্লাউজ এর প্রচলন করেন । সুচিত্রা সেনের সাদাকালো ছবিতে যে সব লেইস দেয়া ব্লাউজ এর দেখা পাওয়া যায় তাদের আদি উৎস এই ঠাকুর বাড়ির নারীরা । সে সময় অবশ্য ব্লাউজ ব্যবহার করার জন্য কম কটু কথা শুনতে হয় নি এদের । বাঙ্গালী নারীদের মাঝে এরাই আবার প্রথম জুতা পায়ে দেয়াও শুরু করে ।
লাক্স চ্যালেন আই সুপার স্টার এর এক নারী শাড়ী পরেছে ব্লাউজের নিচে । অনেকে মেয়েটাকে নসিহত করছে ব্লাউজের নিচে শাড়ী পরলেই সুপারওমেন হওয়া যায় না । অনেক বলছেন সংস্কৃতি ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র। অনেকে বলছেন নাড়ীকে পন্য করা হয়েছে । বাস্তবতাটা আপনারাই চিন্তা করেন ।